বৃহস্পতিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৩

জমজম এর ইতিহাস

জমজম এর ইতিহাস


মহান আল্লাহতায়ালার অশেষ কৃপায় আল্লাহর খলিল হজরত ইব্রাহীম (আঃ)’র ৯৯ বছর বয়সে তাঁর ছোট পরিবার হাজেরার গর্ভে একটি ছেলে সন্তান জন্মলাভ করে। তাঁর নাম রাখা হয় ইসমাঈল (আঃ)। ছেলেটি যেন সোনার পুতুল, স্বর্গীয় নূরে যেন তাঁর সর্বাঙ্গ পরিপূর্ণ। তাঁর দিকে তাকালে মনে হয় সৃষ্টির কোনো রহস্য তাঁর মাঝে লুকায়িত আছে। তাঁর দ্বারা সৃষ্টির কোনো রহস্য উদঘাটিত হবে, যার ফলে হজরত ইব্রাহীম (আঃ) সন্তানসহ তার মা হাজেরাকেও খুব আদর, সোহাগ, স্নেহ এবং প্রাণঢালা ভালোবাসা দিতে থাকেন।
সর্বজ্ঞ স্রষ্টা, মহান আলস্নাহতায়ালার হেকমতের মহাকৌশল কে বুঝতে পারে? এই নবজাত শিশু সন্তানের দ্বারা পুণ্যময় ভূমি মক্কায় রহমতের আধার বরকতময় ঝর্ণাধারা ঝমঝম কূপ আবিস্কৃত হবে। সমগ্র জগতের পূণ্যতীর্থ মহাপবিত্র কাবা গৃহ পুনঃনির্মাণ হবে। তাঁর বংশেই নিখিল বিশ্বের ত্রাণকর্তা, রহমতের ভাণ্ডার সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) মক্কানগরে আগমন করবে। তার বংশধারায় নির্জন মরু প্রান্তর আরব দেশ আবাদ হবে। তাই সর্বনিয়ন্তা এই নবজাত শিশু সন্তানটিকে মরু প্রান্তরে প্রেরণের সুব্যবস্থা করলেন। হজরত ইব্রাহীম (আঃ)’র বড় পরিবার বিবি সারা বেগম, তার গর্ভে কোনো সন্তান না হওয়াতে তিনি নিজেই স্বামী ইব্রাহীমকে (আঃ) দ্বিতীয় বিবাহ দেন বিবি হাজেরার সাথে। হাজেরার গর্ভে সন্তান জন্ম হওয়াতে ইব্রাহীম (আঃ) হাজেরা ও নবজাত সন্তান ইসমাঈলকে (আঃ) আদর-সোহাগ করতে দেখে বিবি সারার মনে বিরৃপ প্রক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ফলে একদিন বিবি সারা তার স্বামীকে বললেন, এই মাতা-পুত্রকে আমার চক্ষুর আড়াল করুন। হজরত ইব্রাহীম (আঃ) আল্লাহর নির্দেশের অপেক্ষায় রইলেন।
একদিন আল্লাহর নির্দেশ হলো, ‘হে ইব্রাহীম! সারার মন রক্ষার্থে আপনি ইসমাঈল (আঃ) ও হাজেরাকে তরুলতাহীন নির্জন মরু প্রান্তে নির্বাসন দিন, যাতে তাঁর দ্বারা এমন অভিনব মহানিদর্শন সৃষ্টি হয়। যা কিয়ামত পর্যন্ত অটুট থাকবে।’ হঠাৎ করে একদিন ইব্রাহীম (আঃ) তার আদরের দুলাল নয়নের তারা শিশুপুত্র ইসমাঈল (আঃ) এবং প্রিয় সহধর্মিণী হাজেরাকে নিয়ে এক বিরাট মরু প্রান্তরে উপনীত হন। যেখানে কোনো প্রকার তরুলতা, গাছপালা, নদ-নদী, খাদ্য,পানীয় এমনকি কোনো জনমানব পর্যন্ত নেই। যেদিকে চোখ যায় ধু-ধু মাঠ আর মাঠ, বালি আর বালি।
হজরত ইব্রাহীম (আঃ) ধৈর্য ধারণপূর্বক নবজাত শিশু সন্তানসহ বিবি হাজেরাকে সেখানে রেখে প্রস্থানের জন্য উদ্যত হন। তখন হাত তুলে প্রার্থনা করে বলেন, ‘হে আল্লাহ! আমি নবজাত শিশুকে নিরীহ মাতাসহ নির্জন প্রান্তরে রেখে গেলাম, তা কেবলমাত্র তোমারই নৈকট্য লাভের আশায়। হে আল্লাহ! এই জনমানবহীন ভীষণ প্রান্তরে আমি তাদেরকে তোমারই হাতে ন্যস্ত করলাম। তাদের তত্ত্বাবধানের ভার-দায়িত্ব তোমার ওপরই রহিল।’
অতঃপর এক মশক পানি আর কিছু খেজুর হাজেরার হাতে দিয়ে ইব্রাহীম (আঃ) প্রস্থান করলেন। এমন সময় হাজেরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে স্বামীকে জড়িয়ে ধরে বললেন, হে আমার শ্রদ্ধেয় স্বামী! আপনি কি আমাদের ওপর অসন্তুষ্ট? আপনি আমাদের কেন, কার কাছে এই ভয়সংকুল প্রান্তরে রেখে যান?’ এই হ্নদয়বিদারক প্রশ্নে ইব্রাহীম (আঃ)’র অন্তরে যে আঘাত লেগেছে, তা ভুক্তভোগী ব্যতীত অন্য কারো পক্ষেই হ্নদয়ঙ্গম করা সম্ভব নয়। ইব্রাহীম (আঃ) আত্মসংবরণকরত স্থির কণ্ঠে উত্তর দেন, আমি তোমাদের আল্লাহর হাতে সমর্পন করছি। আর তা কেবল মাত্র আল্লাহর নির্দেশেই। এই উত্তর শুনে হাজেরার মনের উদ্বেগ তিরোহিত হলো, তিনি স্বামীকে ছেড়ে দিলেন, ইব্রাহীম (আঃ) চলে যান। হজরত ইব্রাহীম (আঃ) হাজেরাকে যে পানি আর খেজুর দিয়েছিলেন তা কয়েকদিনের মধ্যেই নিঃশেষ হয়ে যায়। কয়েকদিন অনাহারে থাকার কারণে হাজেরার দেহের পানি শুকিয়ে যায়। যার ফলে তার বুকে এক ফোঁটা দুধও আর দেখা গেল না। এ অবস্থায় নবজাত কচি শিশু ক্ষুধার তাড়নায় ছটফট করতে থাকে। কচি শিশু সন্তানের এই করুণ পরিণতি দেখে হাজেরা ধৈর্য হারা হয়ে পড়েন। এখন শিশু সন্তানের প্রাণ ওষ্ঠাগত দেখে তিনি পার্শ্ববর্তী ছাফা পাহাড়ের উপর উঠে চারদিক তাকাতে লাগলেন। কিন্তু কোথাও পানি বা খাদ্যের কোনো নিদর্শন না পেয়ে কিছু দূরে মারওয়া নামক অপর পাহাড়টিতে উঠে পানির সন্ধান করতে লাগলেন। এভাবে হাজেরা উভয় পাহাড়ে সাতবার পর্যন্ত আসা-যাওয়ার মাধ্যমে যখন উঠানামা করতেছিলেন, তা আল্লাহর কাছে খুবই পছন্দনীয় হয়েছে বিধায় তা ইসলামের ধর্মানুষ্ঠানের অন্তর্ভুক্ত হজ ও ওমরার মাধ্যমে শামিল করেন। এই পূন্যব্রত ওমরাহ বিবি হাজেরা এবং শিশু ইসমাঈলের (আঃ) স্মৃতিচিহ্ন স্বরূপ পুণ্য হজের অঙ্গরূপে কিয়ামত পর্যন্ত অটুট থাকবে। হাজেরা যখন সপ্তম বার মারওয়া পাহাড়ে আরোহন করেন, ঠিক তখনই পরম করুণাময় আলাহর রহমতের সমুদ্র উথলিয়ে উঠে। এদিকে হজরত জিব্রাইল (আঃ) শিশু ইসমাঈলের (আঃ) পায়ের পদাঘাতের স্থানে মিষ্টি পানির এক পবিত্র উৎস রচনা করে দেন। হাজেরা নিরূপায় হয়ে সন্তানের কাছে ফিরে এসে দেখেন, ইসমাঈলের পদতল থেকে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। তা দেখে তিনি অধিক আনন্দিত হন এবং প্রাণ ভরে পানি পান করে, আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেন। অপরদিকে প্রবাহিত পানি নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় তিনি চতুর্দিকে দ্রুত বালুর বাঁধ দিতে লাগলেন। পানির এ উৎসটিই ঝমঝম কূপ নামে পরিচিত। আর এটিই হলো হজরত ইসমাঈল (আঃ)র শৈশব কালের অমর কীর্তির মোজেজা।
বিবি হাজেরা পানি আবদ্দ রাখার জন্য যখন বালি দ্বারা বাঁধ দিতে ছিলেন, তখন পানি প্রবল বেগে প্রবাহিত হওয়ার কারণে বাঁধ ভেঙে যেতে দেখে, পানির দিকে লক্ষ্য করে বললেন, "ঝমঝম" অর্থ- থাম, স্থির হও। তখন আল্লাহর কুদরতে পানি আর চারদিকে প্রবাহিত না হয়ে পানি স্থির হয়ে যায়। আর ওই কুপের নামকরণ করা হয় ঝমঝম কূপ, এতে আছে স্বর্গীয় মহাপবিত্র আবে রহমত ও বরকত।
ঝমঝমের পানি একদিকে যেমন ক্ষুধা ও তৃষ্ণা উভয়টিই নিবারণ করে থাকে। অপরদিকে তেমনি পেটের হজম শক্তি বাড়িয়ে শরীরকে পুষ্ট ও বলিষ্ঠ করে তোলে। ঝমঝম পানির উৎপত্তি হয়েছিল সদ্যোজাত শিশু ইসমাঈলের (আঃ) পিপাসা নিবারণের জন্য। এ প্রবাহিত ঝরণা ধারা সেই থেকেই বিশ্বমানবের কল্যাণে অনবরত পানির প্রবাহ যুগিয়ে চলছে। কালক্রমে মক্কার কাবা শরীফের কতৃত্বকে কেন্দ্র করে শুরু হয় জরহম গোত্রের সাথে সীমাহীন দ্বন্দ্বের সৃষ্টি, তখন জরহম গোত্রের নেতা সায়ায সব অস্ত্রশস্ত্র ও স্বর্ণ হরিণশাবক ইত্যাদি এই ঝমঝমের মধ্যে নিক্ষেপ করে মাটি পাথর দিয়ে তা বন্ধ করে নিশ্চিহ্ন করে চলে যায়। এতে মানুষ পানির জন্য ভীষণ কষ্ট ভোগ করতে থাকে।
আজ থেকে প্রায় ১৫০০ বছর পূর্বে কাবাগৃহের মুতাওয়াল্লী মহানবী হজরত মহাম্মদ (সাঃ)র দাদা আবদুল মোত্তালেব এ মহাপবিত্র বরকতময় পানি ঝমঝম কূপ পুনরুদ্ধারের আয়োজন করেন। নিজ পুত্র হারিসকে আশপ ও নায়ল নামক দেবমূর্তির সামনের অংশের মাটি খুঁড়ার আদেশ দেন। কিন্তু বাদ সাধল ওইসব দেবতার উপাসক গোষ্ঠী, কিন্তু হজরতের দাদা আবদুল মোত্তালিব সব বাধা বিপত্তিকে সরিয়ে ওই স্থানেই খনন কার্য চালিয়ে ঝমঝম কূপ পুনঃরুদ্ধার করেন। বিশ্ববাসীর কল্যাণের লক্ষ্যে আল্লাহর দান মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে পড়ল সেই পুরাতন পুত-পবিত্র জলধারা মিষ্টি পানির ফোয়ারা ঝমঝম কূপটি।
আল্লাহ আমাদেরকে তাওফিক দান করুন আমরা যেন ঈমানের সাথে ইসলামী রীতিনীতিতে হজ কাবা করে স্বর্গীয় পানি আবেশেফা, আবে রহমত ও বরকতময় ঝমঝম কূপের পানি পান করতে পারি। আমীন!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন